Home » 2011 » January » 2 » voyongker songkha
11:36 PM
voyongker songkha

ভয়ঙ্কর এক সংখ্যার জন্ম, নিষ্ঠুর এক খুনের গল্প (পর্ব ১)

দক্ষিণ ইটালি, বৃহত্তর গ্রিসের (Magna Grecia) ক্রোটন নগর

[১]
৫ম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষভাগ

"আচ্ছা, সবাই বলে ভ্রাতৃগোষ্ঠির সদস্যরাই তাকে মেরে আইওনিয়ান সাগরে তার লাশ ফেলে দিয়েছিল! গুরু নিজেই নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন এ কাজে?” উদ্বিগ্নতা আর তীব্র কৌতূহলে মেয়েটি জানতে চায় যুবকের কাছে।
"হশ্‌শ্‌…”মুখে তর্জনী রেখে দ্রুত চারদিকে তাকায় যুবক।

অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোয় ভরে গেছে গাঢ় সবুজ জলপাই অরণ্য, খেলা করছে বৃক্ষশাখা আর পত্রপল্লবের ছায়া। মাঝেমাঝে আইওনিয়ান সাগরের বুক থেকে ভেসে আসছে দমকা হাওয়া, তার তোড়ে জায়গা বদল করে আলো-ছায়া। না, কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

তবু অ্যাডোনিয়াকে সাবধান করে ফিলোক্রেটস, "আস্তে কথা বলো, কে কী শুনে ফেলে, বিপদে পড়ব আমরা।”
গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে অ্যাডোনিয়া, "কিন্তু এ কি সত্যি?”
"আরে না, তা হবে কেন?” তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে ফিলোক্রেটস। "সাগরে ঝড় উঠেছিল সেদিন, আর সে দাঁড়িয়ে ছিল জাহাজের খোলা জায়গায়। প্রচণ্ড এক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে।”
"সে একাই কেন দাঁড়াতে গেলো খোলা জায়গায়?” প্রশ্ন করে অ্যাডোনিয়া, সন্দেহ দূর হয় না তার। "আর, বছরের এ সময় ঝড়ের কথা তো কখনো শোনে না কেউ, মাছরাঙা দিন [halcyon days] চলছিল তখন!”

"অ্যাডো, গুরু কেন এ কাজের নির্দেশ দিতে যাবেন? সত্যানুসন্ধানী মানুষ তিনি, কেবল সত্যেরই লেনদেন করেন। একটি সংখ্যা আবিষ্কারের জন্য কেন মানুষ খুন করাবেন তিনি?” ফিলোক্রেটসের গলার স্বর দৃঢ় হয়ে উঠে।
"কারণ গুরুর সারা জীবনের দর্শন আর শিক্ষার ভীত দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল সংখ্যটি। তিনি কঠোরভাবে চেয়েছিলেন তা গুপ্ত থাকুক, কিন্তু সে প্রকাশ করে দিয়েছে।”

"আমি তা বিশ্বাস করি না, অ্যডো। তুমি জানো, তাঁর কাছে বিদ্যাশিক্ষার বিনিময়ে আমাকে প্রতিদিন তিন অবোলি [oboli] করে দিতেন! এরকম অদ্ভুত শিক্ষক, যিনি পড়ানোর বিনিময়ে ছাত্রকেই পারিশ্রমিক দেন, আর একজন খুঁজে পাবে না তুমি। এ ধরণের মানুষ কখনো কাউকে হত্যা করতে পারেন না। আমি তাকে চিনি বলেই, জন্মভূমি সামোস ছেড়ে কেবল তাঁর দর্শন শেখার জন্য ক্রোটন এসেছি।” এক টানে বলতে থাকে ফিলোক্রেটস, একটু উষ্ণ তার গলা।
খানিক পর আর্দ্র হয় যুবকের কণ্ঠ। "অবশ্য তা না হলে তোমাকেও পাওয়া হতো না,” অ্যাডোনিয়ার কাঁধে দু’হাত রেখে আলতো করে তার কপোল ঘষে দেয় ফিলোক্রেটস। সোনালি অলকগুচ্ছ নড়ে উঠে মেয়েটির, ভূমধ্যসাগরের গাঢ় নীল জলরাশির মতো চোখ মেলে গভীর ভালোবাসা আর মায়ায় গণিতপাগল স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে সে।

[২]
এর এক বছর আগের কথা।

চমৎকার করে কেটে, মসৃণভাবে লেপে দেয়া অর্ধবৃত্তাকার মাটির ঢিবি— সেমিসার্কেল (semicircle)। ব্যাস লাইন বরাবর ঝুলছে ভারী পর্দা। অর্ধবৃত্তের ধার ঘেঁষে ইতোমধ্যেই সমবেত হয়েছে অনেক তরুণ-তরুণী, ভ্রাতৃগোষ্ঠির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শাখা ম্যাথমেটিকোই (Mathematici)’র অন্তর্ভুক্ত তারা, অর্জন করেছে স্বচক্ষে গুরুকে দেখা ও তাঁর ভাষণ শোনার বিরল কৃতিত্ব। এর আগে তারা ছিল ভ্রাতৃগোষ্ঠির আরেকটি শাখা অ্যাকৌজমেটিকোই (Acusmatici)’র সদস্য, তিন বছর তীব্র কৌতূহলে শুধু গুরুর ভাষণই শুনে গিয়েছিল, পর্দার আড়ালের মানুষটি দেখতে পায়নি কখনো, কারণ তার জন্য আগে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।

গভীর উদ্দীপনায় অপেক্ষা করছে ম্যাথমেটিকোইয়ের সদস্যগণ, দিনের পর দিন তারা এভাবেই অপেক্ষা করে আসছে গুরুর আগমনক্ষণটিতে। আজকে কী নিয়ে কথা বলবেন গুরু ভাবতে থাকে তারা, আর পরিকল্পনা করে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কীভাবে নিজেদের যোগ্যতা মেলে ধরবে।

বাজনা বেজে উঠে অর্ধবৃত্তের অভ্যন্তরে, শোনা যায় জনপ্রিয় গ্রিসীয় সঙ্গীত, পর্দা সরে যায় দু’পাশে। সাদা আলখেল্লা পরিহিত, পায়ে সোনালি পাদুকা, আর মাথায় গ্রিসীয় ফুলের মুকুট, জলপাইয়ের পাতা গোঁজা তাতে, রাজকীয় মহিমায় প্রবেশ করেন সৌম্য চেহারা মানুষটি—পীথাগোরাস, সেমিসার্কেলের শিক্ষক, ভ্রাতৃগোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনের প্রচারক।

কেমন আছ তোমরা, হে অভিমন্ত্রিত [initiated] সত্যব্রতগণ?” দু’হাত প্রসারিত করে হাস্যপ্রোজ্জ্বল মুখে জানতে চান পীথাগোরাস।
"চমৎকার, হে মহান গুরুদেব!” সমস্বরে বলে উঠে সবাই।
"তোমরা হচ্ছ নির্বাচিতগণ,” শান্তস্বরে বলেন পীথাগোরাস,”তোমরা পরিহার করবে সব ধরণের উগ্রবাদিতা। সর্বোতপ্রচেষ্টায় তোমাদেরকে অপসারণ করতে হবে, এবং ছিন্ন করতে হবে অগ্নি ও তরবারির মাধ্যমে, এবং আরো নানাবিধ উপায়ে, দেহ থেকে অসুস্থতা, আত্মা থেকে অজ্ঞানতা, উদর থেকে ভোগবিলাস, নগরী থেকে অরাজকতা, পরিবার থেকে বিভেদ, এবং সকল ক্ষেত্রে বাহুল্য।”
"জী, গুরুদেব।” সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকে বাণীটি।

পীথাগোরাসের নেতৃত্বে ভ্রাতৃগোষ্ঠির সদস্যগণ অতঃপর মেতে উঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনায়, নিয়ন্ত্রিত বিতর্কে, প্রশ্নোত্তরে। কেটে যায় বেশ কয়েক ঘন্টা, শেষ হয় প্রথম পর্বের আলোচনা।

অপরাহ্নে, অড্রিয়াটিক সাগর থেকে উঠে আসা বর্ষবায়ু (etesian wind) যখন বয়ে যাচ্ছিল আয়োনিয়ার উপর, দলটি আবার সমবেত হয়, এবার আলোচনার বিষয়বস্তু অতিন্দ্রীয় শাস্ত্র (esoterica)।
"আপনার জীবনের কথা বলে আমাদের সম্মানিত করুন, হে গুরুদেব।” লুকানিয়া থেকে আগত কমনীয় চেহারার মেয়েটি, ঈসারা (Aesara) তার নাম, উঠে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে; তীব্র কৌতূহলে নড়েচড়ে বসে সবাই।

স্মিতহাস্যে আলখেল্লাটি ঠিক করে নেন পীথাগোরাস। মনে তাঁর ভীড় করে কত না স্মৃতি—নদী, দরিয়া আর পথের অন্তহীন বয়ে চলা, নগর ও বন্দরসমূহের শান-শওকত, উত্থান-পতন, নানা জাতির মানুষ, দেহ ও মনে তাদের হরেক রঙের খেলা; সম্মোহিত হয়ে যান দার্শনিক কয়েক মুহূর্তের জন্য।

"সাতচল্লিশতম অলিম্পিয়াডের প্রাক্কালে জন্ম আমার। আমার বাবা নেসারকাস (Mnesarchus) ছিলেন ফিনিশিয়ার [Lebanon] বন্দরনগরী টায়ারের (Tyre) মুক্তা ব্যবসায়ী, মা ঈজিয়ানতীরে সামোস নগরীর (Samos) মেয়ে পার্থেনাস। সামোসের ভয়ানক দুর্ভিক্ষে বাবা একদা প্রচুর খাদ্শস্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, ফলে নগরীর অধিকর্তাগণ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে সামোসের নাগরিকত্ব দান করেন।

আমি যখন মাতৃগর্ভে, মা’কে নিয়ে বাবা পার্নেসাস পর্বতের পাদদেশে ডেলফাই’র(Delphi) দৈববাণীর মন্দিরে গমন করেন, এপোলোর সন্ন্যাসিনী পীথিয়ার (Pythia, Pythoness) ওরাকল শুনতে। পীথিয়া আমার পিতাকে তাঁর জাহাজের জন্য অনুকূল বাণিজ্যবায়ুর ভবিষ্যতবাণী ব্যক্ত করে, এবং সুসংবাদ প্রদান করে আমার আগমনের, যা বাবা তখনও জানতেন না। ডেলফাই থেকে টায়ারে ফেরার পথে সিডন (Sidon) বন্দরে আমার জন্ম হয়। বাবা-মা খুশিতে সন্ন্যাসিনীর নামানুসারে আমার নাম রাখেন পীথাগোরাস—পীথিয়া’র মতো কথা বলে যে।

জগতকে জানার অদম্য স্পৃহা আমার উপর ভর করে সেই শৈশবেই, বাবার বাণিজ্য অভিযাত্রায় প্রায়ই তাঁর সহযাত্রী হতাম আমি। এভাবে ঈজিয়ান, এশিয়া মাইনর এবং ফিনিশিয়ার তীরে হাঁটতে হাঁটতে বড় হতে থাকি আমি।

আমার বিদ্যাশিক্ষার জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নিয়োগ করেন বাবা। ছেলেবেলায়ই শামদেশের (Syria) বিদ্বজ্জনদের কাছে দীক্ষা লাভ করি আমি, সংস্পর্শে আসি আমার প্রিয় শিক্ষক ফেরেকাইদেসের (Pherekydes)।

অষ্টদশ বর্ষ বয়স পূর্ণ হলে আমি গমন করি মাইলিটাস নগরে, গ্রিক জ্ঞানের পুরোধা বৃদ্ধ থেলিজ (Thales) ও তাঁর ছাত্র অ্যানাক্সিম্যান্ডরের (Anaximander) সাহচর্য লাভ করি। পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য থেলিজ আমাকে কৃষ্ণ ও লোহিত মৃত্তিকার দেশে (Khemet-Deshret) গমন করতে উদ্বুদ্ধ করেন।

দূরদেশ গমনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সিডন বন্দরে ফিরে আসি আমি, এখানে আরো কিছুকাল বিবলস ও টায়ারের যাবতীয় অতিন্দ্রীয় শাস্ত্রে অভিমন্ত্রিত হই। তারপর শুভ এক দিনে কারমেলাস পর্বতের পাদদেশে কৃষ্ণ ও লোহিত মৃত্তিকার দেশ মিশরগামী এক জাহাজে আরোহণ করি আমি।

মিশরের ফারাও আমাসিস (Ahmose II) এবং তাঁর গ্রিক স্ত্রী রদোপেস [Rodhopes, ইনি প্রাচীনতম সিন্ডারেলা, যার উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীর নানা দেশে সিন্ডারেলা কাহিনী ছড়িয়েছে এবং ঈশপ যাকে রূপকথা শোনাতেন] আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন। ফারাওয়ের প্রাসাদে কিছুদিন কাটানোর পর তাঁর রাজ্যের উচ্চ পুরোহিতদের কাছে দীক্ষা নেবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি আমি, রাজা তখন আমাকে একটি সুপারিশনামা লিখে পাঠিয়ে দেন মেমফিসের মন্দিরে ও পিরামিডে।

কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ মিশরীয়রা চূড়ান্ত রকমের গোপনীয়তা অবলম্বন করত তাদের জ্ঞান-সাধনায়, যেরকম করে গিয়েছিল ত্রিভূবনের জ্ঞানী থোথ-হার্মিস-ট্রাইম্যাজিস্টাস। তিন দিবস তিন রজনী আমি অতিবাহিত করি পাথরের শবাধারে (sarcophagus), মিশমিশে অন্ধকার এক গুপ্ত প্রকোষ্ঠে, আলোর প্রতীক্ষায়। আস্তে আস্তে আলোড়িত হতে থাকে শরীর আমার, বাড়তে থাকে হৃদস্পন্দন, ধীরে ধীরে চেতনা হারাই আমি। আমি অনুভব করি আলো, ভাসতে থাকে সত্তা আমার, অনন্তকালের গর্ভে, ফিনিক্স পাখির মতো উড়তে থাকে আমার আত্মা। চারপাশে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করি আমি, অবলোকন করি আকার ও সংখ্যা।

"তুমি এখানে, পুনরুজ্জীবিত, অনুভব করেছ মহান রহস্য। মৃত্যুকে পরাভূত করেছ তুমি, অর্জন করেছ মৃত্যুঞ্জয়তা।” তিন দিন পরে উচ্চ পুরোহিত সঞ্চিসের গলার স্বরে জাগরণ আসে আমার। "এসো, অভিমন্ত্রিতদের গৌরব উদযাপন কর। তুমি হয়েছ আমাদেরই একজন, লাভ করেছ নবজন্ম।”

২২ বছর মিশরে কাটাই আমি, আয়ত্ত করি তাদের জ্যামিতিক জ্ঞান, সান্নিধ্যে আসি দড়ি-প্রসারণকারীদের (rope stretcher)। প্রতিবছর নীল নদের বন্যায় ভেসে যেত জমির খাড়া আল, ফারাও তখন নীলের অববাহিকায় পাঠাতেন দড়ি-প্রসারণকারীদের, কতটুকু জমি কমে গেল তা পরিমাপ করতে। পরিমাপের কাজে সূক্ষ্মভাবে সমকোণ বানানোর প্রয়োজন হতো তাদের, এর জন্য সমান দূরত্বে তৈরি করা ১২টি গিঁটের দড়ি নিত তারা। তারপর মাঝ থেকে এমনভাবে ৩ গিঁট নিত, যাতে একপাশে ৪গিঁট ও অন্যপাশে ৫ গিঁট থাকে এবং তাদের প্রান্ত জোড়া দিয়ে একটি ত্রিভুজ সৃষ্টি করা যায়, যা সবসময় সমকোণ সৃষ্টি করে। অন্য কোনো ভাবে গিঁট নিলে কখনো সমকোণ হতো না।

মহান থেলিজও আমাকে এই ত্রিভুজের কথা বলেছিলেন, গভীরভাবে তা নিয়ে ভাবতে থাকি দিনের পর দিন। বহু বছর পর আমার সমকোণী ত্রিভুজের সূত্র আবিষ্কারে দড়িপ্রসারণকারীদের ত্রিভুজের অবদানের কথা আমি অস্বীকার করতে পারি না।

বাইশ বছর পর সামোসে ফেরার প্রস্তুতি নেই আমি। ফারাও আমাসিস মারা গেছেন ততদিনে, উচ্চ ও নিম্ন মিশরের অধিপতি এখন তাঁর ছেলে তৃতীয় সামতিক (Psamtik III)। আর এ সময়ই মিশরে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা, ফিনিশিয়ার তীর ঘেঁষে সিরোক্কো হাওয়ার মতো প্রবল প্রতাপে মরুভূমি ধরে মিশরের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে আসুর-রাজ (Assyrian/Persian) ক্যাম্বাইসিজ (Cambyses II)।

ভয়ঙ্কর এক সংখ্যার জন্ম, নিষ্ঠুর এক খুনের গল্প ( শেষ পর্ব )

ফারাও আমাসিস। আহ্‌, কী দূরদর্শী প্রতাপান্বিত সম্রাটই না ছিলেন তিনি! বয়স হয়েছিল বেশ, অন্তিম শয়ানে তখন, তারপরও রণকৌশল সাজিয়ে গেছেন তিনি, রাজধানী মেমফিসের চারপাশে গড়ে তুলেছেন কঠিন প্রতিরক্ষাবেষ্টনী। দক্ষিণ-পশ্চিম আনাতোলিয়া’র (Turkey) কারিয়া এবং গ্রিস থেকে ভাড়াটে সৈন্য এনে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন সেনাদল, মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন সামোসের পলিক্রেটিজকে, যাতে পলিক্রেটিজের বিশাল নৌবহর গাজা থেকে পেলুসিয়াম (Pelusium) পর্যন্ত সঙ্কীর্ণ মরুপথটিতে অরক্ষিত পার্সি বাহিনীর উপর শাম সাগর (Syrian Sea) থেকে ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালায়।

যুদ্ধ শুরু হবার কিছু দিন পূর্বে বিশ্বাঘাতকতা করে পলিক্রেটিজ। ক্যাম্বাইসিজের পক্ষে যোগ দেয় তার নৌবহর, বিনা বাধায় পার্সি সৈন্যদল পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে পৌঁছে যায় পেলুসিয়াম উপসাগরের তীরে। আর এ সময় মারা যান বৃদ্ধ আমাসিস, সিংহাসনে আরোহণ করেন সামতিক—সে কেবল কয়েক মাসের জন্য। পেলুসিয়ামে পরাজিত হয় মিশরবাহিনী, ক্যাম্বাইসিজ অগ্রসর হতে থাকেন আরো পশ্চিমে, হেলিওপলিসের পতন ঘটিয়ে পৌঁছে যান রাজধানী মেমফিসের সদর দরজায়। কয়েক মাস অবরোধের পর ভেঙে পড়ে মেমফিস।

পারস্যরাজ আমাকে বন্দি করে ব্যাবিলনে (Babylon) নিয়ে আসেন, কিন্তু রহস্যময়ভাবে মুক্তভাবে সেখানে চলাচল করতে দেন। অপ্রত্যাশিত সুযোগটি আমি কাজেই লাগাই জ্ঞান সাধনায়—প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞানীদের (magi) কাছে দীক্ষালাভ করি অতিন্দ্রীয় শাস্ত্রে, আয়ত্ত করি ক্যালডীয় (Caldean) পুরোহিতদের ধর্মাচার, অর্জন করি নক্ষত্র-অবলোকনকারীদের (star-gazer) গণিত ও জ্যোতির্জ্ঞান। সমকোণী ত্রিভুজ নিয়ে এদেরও ছিল সুতীব্র আকর্ষণ যা আমাকেও তীব্র আলোড়িত করে।

আনুমানিক ১৮০০-১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি ব্যাবিলনীয় শিলাখণ্ড যেখানে কীলক-লিখনের (cuneiform) সাহায্যে ২-এর বর্গমূলের মান ৬০-ভিত্তিক (sexagesimal) পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়েছে; দশমিক পদ্ধতিতে রূপান্তর করলে বর্গমূলটির মান দশমিকের পর ৫-ঘর পর্যন্ত সঠিক হয়। সৌজন্যে, উইকিপিডয়া

এক যুগ কাটাই আমি ব্যাবিলনে। পারস্যরাজ ক্যাম্বাইসিজ ও গ্রিক স্বৈরাচারী (tyrant) পলিক্রেটিজের মৃত্যু হয় ইত্যবসরে, ফলে সামোস ফিরে আসি আমি। তারপর ক্রিট দ্বীপে কিছু দিন আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করে আবার সামোসে ফিরে একটি বিদ্যালয় চালু করার মনঃস্থির করি।

আহ্‌, সামিয়ানবাসীরা ছিল খুব ব্যস্ত, বিদ্যাশিক্ষার মতো অগুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের সময় ছিল অপ্রতুল। সামগ্রিক বিবেচনা করে চলে আসি ক্রোটন, এখানেই আদিষ্ট আমি, আর সব দার্শনিকের মতো, যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দূরদেশে। তবে সামোসে পেয়েছি আমি নক্ষত্র এক, তোমাদেরই একজন সে, তোমাদের মতোই আলোকিত, প্রিয় ফিলোক্রেটজ।

"এ-ই হচ্ছে আমার গল্প, হে স্বর্গীয় আলোর দিশারীগণ, হে নির্বাচিত অভিমন্ত্রিতগণ।” পীথাগোরাস শেষ করেন তাঁর কাহিনী, সসম্ভ্রমে সবাই তাকায় ফিলোক্রেটজের দিকে।

সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমাকাশে, ধীরে ধীরে শীতল হয়ে উঠে ভূমধ্যসাগরীয় রাত। "জগতের সবই সংখ্যা, পূর্ণসংখ্যা, যাদের রয়েছে বাস্তব, স্বকীয় অস্তিত্ব।” রহস্যময়ভাবে বলে উঠেন পীথাগোরাস। "সংখ্যা-ই জীবন, সংখ্যা-ই মরণ, সংখ্যা গড়েছে জগত-সংসার। মহাবিশ্বের সবকিছুই পূর্ণসংখ্যায় পরিমাপযোগ্য (commensurable), এমনকি শরীর বলো, আত্মা বলো, ন্যায়বিচার বলো, সবই সংখ্যা।

যেকোনো দুটি সংখ্যাকে তোমরা সর্বদা সুবিধামতো তৃতীয় একটি ক্ষুদ্রতর সংখ্যার পূর্ণ গুণিতক আকারে প্রকাশ করতে পার। যেমন ধরো, ক্রোটনের বাজার থেকে ৫ ড্রাকমা ২ অবোলি দিয়ে কিছু জলপাই কিনলে তুমি, সম পরিমাণ জলপাই কিনলে সামোস থেকে ৪ ড্রাকমা ৪ অবোলি দিয়ে। তাহলে অবোলি হিসেবে তুমি পেলে দুটি সংখ্যা:
৩২ [অবোলি] ও ২৮ [অবোলি], যেহেতু ১ ড্রাকমা=৬ অবোলি।

এখন তুমি যদি একটি ক্ষুদ্রতর সংখ্যা, ১৬ [অবোলি] নাও, তাহলে মূল সংখ্যা দু’টি কিন্তু পরিপূর্ণ বিভাজ্য তথা পূর্ণ গুণিতক হচ্ছে না, কারণ ৩২÷১৬=পূর্ণ সংখ্যা, কিন্তু ২৮÷১৬=পূর্ণ সংখ্যা নয়।

এবার তুমি আরেকটু ক্ষুদ্রতর সংখ্যা নিয়ে চেষ্টা কর: ধরো, ১৪। না, এবারও দুটি পূর্ণ গুণিতক হচ্ছে না। কিন্তু এভাবে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি কমিয়ে যেতে থাক, এক সময় দেখবে সেটি ৪ ধরলে দুটি সংখ্যাই পূর্ণ বিভাজ্য হচ্ছে: ৩২÷৪=৮, ২৮÷৪=৭। ৪ হচ্ছে ৩২ ও ২৮-এর সাধারণ পরিমাপক (common measure)।

আবার তুমি যদি ড্রাকমা হিসেব করো, তাহলে সংখ্যা দুটি:
৫ ও ১/৩ [ড্রাকমা] এবং ৪ ও ২/৩ [ড্রাকমা]।

এখন তুমি যদি ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি নাও ১/৩, তাহলে আগের মতো ভাগফল হিসেবে পাচ্ছ দুটি পূর্ণ সংখ্যা:
(৫ ও ১/৩)÷১/৩=১৫ ও ১=১৬
(৪ ও ২/৩)÷১/৩=১২ ও ২=১৪

জ্যামিতিকভাবে বললে, ৩২ ও ২৮ যদি দুটি রেখাংশ হয়, তাহলে ৪ মাপের রেখাংশটি তাদের সাধারণ পরিমাপক। এভাবে ২, ১, ১/২, ১/৪… প্রভৃতিও তাদের সাধারণ পরিমাপক হবে।

আবার ৫ ও ১/৩ এবং ৪ ও ২/৩ দুটি রেখাংশ হলে, তাদের সাধারণ পরিমাপক হবে ১/৩, ১/৬, ১/৯…এসব মানের রেখাংশ।

এভাবে ক্ষুদ্রতর সংখ্যাটি যত ক্ষুদ্র নেবে, এক সময় না এক সময় সেটি দিয়ে মূল সংখ্যাদ্বয়কে ভাগকরলে ভাগফল হিসেবে পূর্ণ সংখ্য পাবেই— মহাবিশ্বের সবকিছুই পূর্ণ সংখ্যায় পরিমাপযোগ্য।

"না, এ সত্য নয়, জগতের সবকিছুই এভাবে পূর্ণ সংখ্যায় প্রকাশযোগ্য নয়। অনেক সংখ্যাযুগল আছে দুনিয়ায় যাদের এরূপ তৃতীয় কোনো সাধারণ পরিমাপক পাওয়া যাবে না, তা যত চেষ্টাই করাই হোক, আর পরিমাপকটি যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রই নেয়া হোক না কেন।

আতঙ্কে শিউরে উঠল ভ্রাতৃগোষ্ঠির সদস্যগণ। প্রখর রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ভয়ানক বজ্রপাতেও এতটা চমকে উঠত না তারা। গুরুর সামনে উচ্চকণ্ঠ হয় না তারা, তাঁর শিক্ষাকে অস্বীকার করা তাদের ভয়ানক দুঃস্বপ্নেরও অতীত; আর এ তো স্পষ্ট বিদ্রোহ, ভ্রাতৃগোষ্ঠির বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত, তাদের সামগ্রিক জীবনাচারণকে অস্বীকার। কে সে দুরাত্মা, পাপিষ্ঠ! আক্রোশে ফেটে পড়তে উন্মুখ ভ্রাতৃগোষ্ঠির সদস্যগণ।

"কে, কে বলেছে এ কথা?” কঠোর থমথমে মুখে প্রশ্ন করেন পীথাগোরাস।
"আমি, হিপ্যাসাস।” মেটাপানটামের (Metapontum) যুবকটি বলে। গত কয়েক দিন অস্থির সময় কেটেছে। আবিষ্কারটির ভয়ঙ্করতায় প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সে, কেঁপে উঠেছিল তার অন্তরাত্মা। তারপরও নানা ভাবে পরীক্ষা করে দেখেছে সে—না, সে-ই ঠিক, পীথাগোরাসের সংখ্যাই জগতের সব সংখ্যা নয়। শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে উচ্চারণ করেই ফেলেছে সত্যটির কথা।
"তুমি জান কী উচ্চারণ করেছে তুমি? এর কী প্রমাণ আছে তোমার কাছে? প্রমাণ করতে না পারলে তার পরিণতি সম্পর্কে ধারণা আছে?” পীথাগোরাস দৃঢ়কণ্ঠে বলেন।
"হ্যাঁ, প্রমাণ আমি করতে পারব। আপনার সমকোণী ত্রিভুজেই লুকিয়ে আছে তা।” ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে হিপ্যাসাসের।
"উঠে এসো এখানে, প্রমাণ কর।”

ভীড় সরিয়ে সেমিসার্কেলে উঠে হিপ্যাসাস। নানা রঙের বালি ও নূড়িপাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন সহকারী। মাটিতে একটি বর্গক্ষেত্র আঁকে হিপ্যাসাস, তারপর নীল বালি ছিটিয়ে রঙিন করে তার বাহুগুলো, আর একটি সবুজ কর্ণ তৈরি করে।
"আপনার কথামতো বাহু-রেখাংশ AB এবং কর্ণ-রেখাংশ AC পরস্পর পরিমাপযোগ্য (commensurable), অর্থাৎ তৃতীয় আরেকটি ক্ষুদ্রতর রেখাংশ তাদের উভয়কে পূর্ণ সংখ্যায় ভাগ করতে পারবে, তাই না?” প্রশ্ন করে হিপ্যাসাস।

"হ্যাঁ, তাই।” ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করে বলেন পীথাগোরাস, স্পষ্টতই এ ধরণের আচরণ, বিশেষ করে শিষ্যদের কাছ থেকে, একেবারে অকল্পনীয়।
"ধরে নেই, তৃতীয় সেই ক্ষুদ্রতর রেখাংশটির মান m। অতএব, AB ও AC উভয়ে m-এর সাপেক্ষে পরিমেয়, যেখানে m হতে পারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। বোঝার সুবিধার্থে ধরে নেই, AC=1000m, AB=707m, যদিও পরে আমরা দেখব আমার পদ্ধতিতে 1000 বা 707-এর কোনো ভূমিকা নেই।”
বর্গের কর্ণ যদি ১০ হস্ত হয়, বাহু তার মোটামুটি ৭ হস্ত; ১০০০ হলে মোটামুটি ৭০০, মনে মনে হিসেব করেন পীথাগোরাস। "ঠিক আছে।” বলেন তিনি।

"এবার কর্ণ AC থেকে AB-এর সমান করে AB1 অংশ কেটে নেই। CB1 কে বাহু ধরে আরেকটি বর্গ আঁকি।” বর্গক্ষেত্রটিকে হিপ্যাসাস এবার লালচে বালি দিয়ে স্পষ্ট করেন। পিনপতন নীরবতা সেমিসার্কেলে, কী একটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন পীথাগোরাস, কপালে বয়সরেখাগুলোতে ভাঁজ পড়তে শুরু করছে।

"এখন ছোট বর্গের বাহু, CB1=1000m-707m=293m (=EB1)।
ত্রিভুজ ABE এবং ত্রিভুজ AB1E সর্বসম, কারণ এরা সমকোণী ত্রিভুজ যেখানে দুটি করে বাহু সমান: AB=AB1, AE সাধারণ বাহু।
ফলে EB1=EB=293m, এবং
ছোট বর্গের কর্ণ, CE=707m-293m=414m।
অতএব আমরা পাচ্ছি, ছোট বর্গের বাহু ও তার কর্ণ পরস্পর m-এর সাপেক্ষে পরিমাপযোগ্য।” হিপ্যাসাস একটি বিরতি নেন।

মৃদু গুঞ্জন উঠে সেমিসার্কেলের চারপাশে, এ-তো ঠিকই আছে, সমস্যা কোথায়! হিপ্যাসাস আবার তার চিত্রে মনোযোগ দেয়, CE রেখাংশ থেকে CB1 এর সমান করে CB2 অংশ কেটে নিয়ে আগের মতো ক্ষুদ্রতর একটি বর্গক্ষেত্র অঙ্কন করে, এবারেরটি বেগুনি বর্ণের।

"আগের মতোই আমরা বলতে পারি, বেগুনি বর্গের বাহু এবং তার কর্ণও m-এর সাপেক্ষে পরিমাপযোগ্য, তা m-এর যত গুণিতকই হোক না কেন? তবে আগের বর্গদুটোর চেয়ে এখানে গুণিতকের মান কম হবে, তাই না?” হিপ্যাসাস প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ।” পীথাগোরাস সায় দেন, স্বর তার ক্ষীণ, যুক্তিশাস্ত্রের কোন শাখা দিয়ে হিপ্যাসাস অগ্রসর হচ্ছে, তা ধরতে পেরেছেন তিনি।
"এভাবে m-এর সাপেক্ষে কর্ণ ও বাহুতে গুণিতকের মান কমতে থাকবে। আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বর্গ এঁকে যেতে থাকব, এক সময় এমন এক বর্গ পাব যার বাহু ও কর্ণ m-রেখাংশটির চেয়েও ছোট হয়ে যাবে, ফলে বাহু ও কর্ণ m-এর সাপেক্ষে আর পরিমাপযোগ্য হবে না।”

খানিক থেমে আবার বলে হিপ্যাসাস, "এখন কথা হলো m কত ছোট হতে পারে। আমি সুবিধার জন্য m-কে এমন ধরেছি যে প্রথম বর্গের কর্ণ 1000m ও বাহু 707m হয়। কিন্তু m যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের হবে, কিন্তু আমি এভাবে অসীম সংখ্যক ক্ষুদ্রতর বর্গ আঁকতে পারব, যখন বর্গের বাহু নির্দিষ্ট mটি থেকে এক সময় ছোট হবে।”

"অতএব, যুক্তিশাস্ত্রের রিডাকশিও এড অ্যাবসার্ডা

Views: 564 | Added by: zazafee | Rating: 0.0/0
Total comments: 0
Name *:
Email *:
Code *: